তাল ও
ছন্দ
সঙ্গীত কলাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে
তাল
একটি
অপরিহার্য কলা।
তালের সঠিক
জ্ঞানের অভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাল
একটি
ভীতিপ্রদ বিষয়
হয়ে
দাঁড়িয়েছে। সময়মত ও
প্রয়োজনীয় সংগতের অভাবে সঙ্গীত শিল্পী যেমন
তাল
শিল্পীকে ভয়
পান,
তেমনি তাল
শিল্পীও ভয়
পান
সঙ্গীত শিল্পীকে। এ
ভয়কে
দূরকরতে দরকার পারস্পরিক সমঝোতা,সহযোগিতা,সাহচার্য আর
সহমর্মিতা। কোন
শিক্ষাথী যদি
সঙ্গীত শিক্ষা শুরু
করার
সময়
থেকেই তালের সাথে
চর্চা না
করে
তবে
তার
মধ্যে তাল
নিয়ে
একটা
অহেতুক ভীতি
কাজ
করবে,যা আর সহজে
দূর
করা
সম্ভব হবেনা। একারণে আমার
এ
স্কুলটিতে যতগুলি পাঠ
সংযোজন করেছি তা
তালবদ্ধ ভাবেই দেয়ার চেষ্টা করেছি,এখানে তালের তত্বীয় দিকটি তুলে
ধরার
চেষ্টা করব।
তাল: তাল হচ্ছে একটি নির্দ্দিষ্ট সময়কে নিদ্দিষ্ট ক্ষুদ্রভাগে ছন্দবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে তাল যন্ত্রে বাদনের মধ্য দিয়ে তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো। প্রকৃতিতে আমরা যা কিছু অবলোকন করি তার সবকিছুই ছন্দবদ্ধ ভাবে একটা নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘটে চলেছে অর্থাৎ সবই তালবদ্ধ। একারণে সব কিছুই আমাদের কাছে এত সুন্দর আর মনোরম বলে মনে হয়। আমরা রেলগাড়ীতে চড়লে এর প্রচন্ড শব্দের মাঝেও ঘুমিযে পড়ি কারণ এর চলার গতি ছন্দবদ্ধ ও এর গতি প্রায় সমান থাকে অথচ হঠাৎ ব্রেক কষলেই আমরা চমকে উঠি কারণ তখন চলার ছন্দ পতন ঘটে। তাই তাল হচ্ছে সঙ্গীতের প্রাণ যার বিচ্যুতি আমাদের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সঙ্গীত জগতে হাজারো তালের জন্ম হয়েছে আবার হারিয়েও গিয়েছে অনেক। তাল যন্ত্রও আছে হাজারো রকমের। এর সবগুলোই যে আমাদের জানতেই হবে তা নয়। প্রাথমিক ভাবে আমরা কিছুতালের সাথে যদি পরিচিত হতে পারি তবে তা আমাদের জ্ঞানের দূয়ার ধীরে ধীরে খুলে দিবে। মাত্রা:তালের মোট সময়টিকে পরিমাপ করার জন্য যে ক্ষুদ্রতম একক ব্যবহার করে লয়কে নির্দ্দিষ্ট করা হয়, এক কথায তাই মাত্রা। পদ বা বিভাগ: তালের প্রতিটি মাত্রা একেকটি পদ। আর তাই,এক বা একাধিক মাত্রা নিয়ে তালকে ছন্দবদ্ধভাবে সাজানোর নামই হচ্ছে পদ বা বিভাগ। তালের এই পদ বিভাজন দুই প্রকার যথা: সমপদ বিভাজন ও অসম পদ বিভাজন। এই বিভাজনের উপর ভিত্তিকরে তালকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। নিম্নে এর বিস্তারিত ব্যখ্যা করা হল। সমপদী তাল:যে সব তালের পদবিভাগ গুলি সমান মাত্রার দ্বারা গঠিত,তাকে সমপদী তাল বলে। যেমন: দাদরা তালটি ০৬ মাত্রা দ্বারা গঠিত,এর পদবিভাগটি হচ্ছে-- ধা ধি না । না তি না।। আর্থাৎ তিন তিন করে সামান মাত্রা নিয়ে এর পদবিভাজন করা হযেছে। কাহারবা,ত্রিতাল,চৌতাল ইত্যাদিও সমপদী তাল। বিসমপদী তাল:যে সব তালের পদবিভাগ গুলি অসমান সেই সব তালকে বিসমপদী তাল বলা হয়। যেমন তেওড়া তালটি ০৭ মাত্রার এবং এর পদবিভাজনটি হচ্ছে-- ধা ধি না । ধি না । ধি না ।। অর্থাৎ তিন দুই দুই করে অসমান ভাবে পদ বিভাজন করা হয়েছে। ঝাপতাল, ধামার ইত্যদিও বিসমপদী তাল। লয়:তালের নির্দ্দিষ্ট সময়কালকে অবিচ্ছেদ্দ্য সমান গতিতে অতিক্রান্ত করার নাম লয়। লয় প্রধানত তিন প্রকার-০১. বিলম্বিত লয় ০২. মধ্যে লয় ০৩. দ্রুত লয়। তবে বিশেষজ্ঞ গণ মনে করেন লয় আট প্রকার। এ ছাড়াও মাত্রার ভগ্নাংশ দ্বারা গঠিত বহুপ্রকার লয় হতে পারে যেমন: আড়,কুয়ড়,বিয়াড় ইত্যাদি। আবর্তন: কোন তালের সম থেকে সম পর্যন্ত বাজিয়ে আসাকে আবর্তন বলে। আবর্ত বা আওয়ার্দ্দা একই কথা। তেহাই: সমান সংখ্যক মাত্রা বিশিষ্ট যে কোন বোল বা বাণী পর পর তিনবার বাজিয়ে গদের মুখে আসাকে তিহাই বলে। তেহাই দুই প্রকার। যথা: দমদার তেহাই ও বেদমদার তেহাই। দমদার তেহাই: যে তেহাই এর মধ্যবর্তী সময়ে দম নেয়ার অবকাশ থাকে তাকে দমদার তেহাই বলে। বেদমদার তেহাই: যে তেহাই এর মধ্যবর্তী সময়ে দম নেয়ার অবকাশ থাকেনা তাকে বেদমদার তেহাই কলে। সম:তালেম প্রথম মাত্রাকে সম বলে। সম থেকেই তালের শুরু। স্বরলিপিতে সমকে +(যোগ) বা x(ক্রস)চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। তালি: পদের যে সব জায়গায় তালি দিয়ে দেখানো হয় তাকে তালি বলে। তালি একটি সশব্দ ক্রিয়া বলে। এই সব স্থান ১,২,৩ ইত্যাদি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। খালি বা ফাঁক: পদের যে স্থান অনাঘাত দ্বারা প্রদর্শন করা হয় তাকে খালি বা ফাঁক বলে। ফাঁক প্রদর্শন একটি নি:শব্দ ক্রিয়া। এসব স্থান ০(শূন্য) দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীনকালে সংগীত গুনীজনেরা তালের দশটি প্রাণের কথা উল্ল্যেখ করেছেন যা নিম্নরুপ:- ০১.কাল: সংগীতে আরোপিত সময়কে কাল বলে। ০২.মার্গ: মার্গ অর্থ পথ। মার্গের দ্বারা আমরা তালের বিভিন্ন স্থান অনুধাবন করতে পারি। ০৩.ক্রিয়া: হাতের দ্বারা তালি বা খালি প্রর্দশন করাকে তালের ক্রিয়া বলে। ক্রিয়া দুই প্রকার যথা: সশব্দ ক্রিয়া ও নি:শব্দ ক্রিয়া। ০৪.অংগ:অংগ অর্থ অংশ বিশেষ। এর দ্বারা তালের অংশ সমূহ চেনা যায়। ০৫.গ্রহ:তালের যে জায়গা থেকে সংগীত শুরু হয় তাকে গ্রহ বলে। গ্রহ চার প্রকার যেমন:- ক)সম গ্রহ:কোন সংগীত যখন সম থেকে শুরু হয় কখন তাকে সম গ্রহ বলে। খ)বিসম গ্রহ:সম ছাড়া যে কোন স্থান থেকে সংগীত শুরু হলে তাকে বিসম গ্রহ বলে। গ)অতীত গ্রহ:প্রকৃত সম গত হওয়ার পর বিশেষ কায়দায় সম প্রদর্শন করাকে অতীত গ্রহ বলে যা আড়ি বলেও পরিচিত। ঘ)অনাগত গ্রহ:প্রকৃত সম আসার পূর্বেই সংগীতের মাধূর্য বৃদ্ধি করার জন্য বিশেষ কায়দায় সম প্রদর্শন করাকে অনাগত গ্রহ বলে। ০৬.জাতি:দক্ষিন ভারতীয় সংগীত রীতিতে ০৫ প্রকার জাতি প্রচলিত যেমন:চতস্র,তিস্র,মিশ্র,খন্ড ও সংকীর্ন। ০৭.কলা:বোলবাণী একই হলেও বাদন শৈলীর ভিন্নতার জন্য বিভিন্ন ঘাড়ানার বাদকদের মধ্যে যে বিশেষ বাদনকৌশল পরিলক্ষিত হয় তাই কলা। ০৮.লয়:তালের নির্দ্দিষ্ট সময়কালকে অবিচ্ছেদ্দ্য সমান গতিতে অতিক্রান্ত করার নাম লয়। ০৯.যত্বি:কোন নির্দ্দিষ্ট লয় বেঁধে দেয়ার নাম হচ্ছে যত্বি। বর্তমানে এর কোন প্রচলন দেখা যায় না। ১০.প্রস্তার:প্রস্তার এর অর্থ হচ্ছে বিস্তার। বোলবাণীর বৈচিত্র আনয়নের মধোদিয়ে বিস্তার করা হয়। বিভিন্ন প্রকার তাল ও এর বিভাগ সমূহ: তাল সম্পর্কিত নিম্নের এই অংশ সমূহ ১৮ জানুয়ারী,১৯৮৯ ইং,সুররং একাডেমী অব ক্লাসিক্যাল মিউজিক এর ১ম ত্রৈমাসিক কর্মশিবির উপলক্ষে প্রদত্তওস্তাদ কামরুজ্জামান(মনি)এঁর ভাষনএর উপর ভিত্তি করে দেয়া হল। তিনি গত ২০ জুন,২০১১ইং পরলোক গমণ করেন। একতাল:একতাল ১২ মাত্রা বিশিষ্ট একটি সমপদী তাল। এই তালটি তিন প্রকার। যথা: ক)দ্বিমাত্রিক একতাল খ)ত্রিমাত্রিক একতাল গ)চতুর্মাত্রিক একতাল এছাড়াও বিলম্বিত একতাল বাজানোর সময় এর প্রতিটি মাত্রা চার মাত্রার সমান করে টেনে বাজানো হয়,ফলে তা ৪৮ মাত্রার মত মনে হলেও মূলত: তা দ্বিমাত্রিক একতাল ১২ মাত্রার একটি বিলম্বিত রুপের ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। ক)দ্বিমাত্রিক একতাল: তালটি ২/২/২/২/২/২ মাত্রা করে মোট ছয়টি পদে বিভক্ত। এর চারটি তালি ও দুইটি খালি। তালি চারটি যথাক্রমে ১,৫,৯, ও ১১ মাত্রায় এবং খালি দুইটি যথাক্রমে ৩ ও ৭ মাত্রায় অবস্থিত। তালের এই প্রকারটি অনেকটা চৌতালের মত। নিম্নে এর ছন্দ বিভাগ দেয়া হল।
দ্বিগুন লয়:
খ)ত্রিমাত্রিক একতাল:তালটি ৩/৩/৩/৩ মাত্রা করে মোট চারটি পদে বিভক্ত। এর তিনটি তালি ও একটি খালি। তালি তিনটি যথাক্রমে ১,৪ ও ১০ মাত্রায় এবং খালিটি ৭ মাত্রায় অবস্থিত। নিম্নে এর ছন্দ বিভাগ দেয়া হল।
দ্বিগুন লয়:
গ)চতুর্মাত্রিক একতাল: তালটি ৪/৪/৪ মাত্রা করে তিনটি পদে বিভক্ত। এর তিনটি তালি য়থাক্রমে ১,৫ ও ৯ মাত্রায় অবস্থিত। এই প্রকারটিতে কোন খালি নাই। নিম্নে এর ছন্দ বিভাগ দেয়া হল।
দ্বিগুন লয়:
বিলম্বিত একতাল:খেয়াল গানে এর বহুল ব্যবহার থাকায় তালটির ছন্দবিভাগ বিস্তৃত ভাবে দেয়া হল:-
(বি:দ্র: এই বিশেষ প্রক্রিয়ার তালটি গুনি শিক্ষক কর্তৃক তালিম গ্রহণ ছাড়া আয়ত্ত করা খুবই কঠিন বলে বিবেচিত) তাল ঝুমরা: এটি একটি ১৪ মাত্রার বিসমপদী তাল। তালটি ৩/৪/৩/৪ করে চারটি পদে বিভক্ত। তিনটি তালি ও একটি খালি বিশিষ্ট তালটির ১,৪ ও ১১ মাত্রায় তালি এবং ৮ মাত্রয় খালি অবস্থিত। এর মধো লয়এর বোলটি নিম্নরুপ:-
বিলম্বিত ঝুমরা:-
ত্রিতাল: তালটি ১৬ মাত্রা বিশিষ্ট একটি
সমপদী তাল।
যা
৪/৪/৪/৪
মাত্রা করে
চারটি পদে
বিভক্ত। তিনটি তালি
ও
একটি
খালি
বিশিষ্ট তালটির ১,৫ ও ১৩
মাত্রায় তালি
এবং
৯
মাত্রায় খালি
অবস্থিত। খেয়াল ও
অন্যান্য গানে
বহুল
প্রচলিত তালটির ছন্দবিভাগ নিম্নে দেয়া
হল।
দ্বিগুন লয়:
বিলম্বিত ত্রিতাল: যে কোন তালকে স্বাভাবিক লয় অপেক্ষা কম লয়ে বাজানোর নাম বিলম্বিত তাল। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত: বিশেষ ধরণের বোল বাজানো হয়,যা ঢিমা লয়কে প্রাণ্জ্ঞল ও লয়কে ধরে রাখতে সাহায্য করে। নিম্নে বিলম্বিত ত্রিতালের একটি বিশেষ ধরণের বোল দেয়া হল:-
|
No comments:
Post a Comment